মৃতদেহ বিক্রয়ের হাট, নবারুণের কবিতা

লেনিনের মতো রেডিক্যাল কথাবার্তা অন্য কোনো রাজনীতিক বা সমাজবিজ্ঞানী বা দার্শনিক বলেছিলেন কিনা আমার জানা নেই। একটা ছোট্ট প্রবন্ধে তিনি রাষ্ট্র নামের প্রতিষ্ঠানটির মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন। লেনিনও রাষ্ট্র সম্পর্কে যেই মতামত দিয়েছিলেন সেটাও আসলে মহাত্মা কার্ল মার্কসের রাষ্ট্রের আন্তঃকাঠামো ব্যাখ্যার ফসল। এই প্রতিষ্ঠানটি তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো অনেক কবি সাহিত্যিককে নিজের দেশে বাস করা অসহনীয় করে তুলেছিল। পৃথিবীর অনেক কবিই নিজের দেশের শাসকদের যাতনায় দেশ ছেড়ে অন্যদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। আবার অনেকেই নিজের দেশের ভেতর থেকেই লড়াই করেছিলেন। কিন্তু কবিতার শক্তি আসলে কতটুকু? একটা বুলেট যে করতে পারে সেটা কি তাৎক্ষনিকভাবে একটা কবিতা করতে পারে? আব্রাহাম লিংকন থেকে শুরু করে পৃথিবীর অনেক শাসকরাই জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার সময় কবিতা আওড়িয়েছেন জনগণের মনোরঞ্জনের জন্য। কবিতা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ শব্দের শ্রেষ্টতম ব্যবহার। ক্ষণিকের জন্য সে মানুষকে উজ্জীবিত করে বটে। আবার প্লাতনের মতো দার্শনিকও কবিদেরকে আদর্শ রাষ্ট্রকাঠামো থেকে বের করে দেন। তাহলে কবিতা কী? সে কি কাঠামোহীনতার কাঠামো? মৌলিক কবি কি তাহলে স্বেচ্চাচারীদের রাজা? তার কবিতাই তার সংবিধান? হয়তো তাই রাষ্ট্র যেমন তার পোষ্য কবি ব্যতীত তার সমালোচনাকারী কবিকে সহ্য করে না তেমনি কবিও তার রাষ্ট্রকাঠামোর জায়গা থেকে রাষ্ট্রকে ছেড়ে কথা বলে না। নবারুণ ভট্টাচার্য তার কবিতার বইয়ের নাম রাখেন এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না। তার আরেকটা বইয়ের নাম পুলিশ করে মানুষ শিকার। এই কবিতাগুলো আগাগোড়াই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর সমালোচনা। রাষ্ট্রের আসল সত্ত্বা সম্পর্কে লেনিন তার রাষ্ট্র নামক প্রবন্ধে বলেন, যেই শ্রেণির হাতে শাসন করার ভার এবং শাসন চালানোর জন্য যাদের হাতে নিয়মিত ও স্থায়ীভাবে রয়েছে বলপ্রয়োগের বিশেষ যন্ত্র, অত্যাচারের যন্ত্র। আপনারা সবাই বোঝেন যে, আজকের দিনে যন্ত্র হলো সশস্ত্র সৈন্যবাহিনি, পুলিশ বাহিনি, কারাগার এবং বলপূর্বক অন্যের ইচ্ছেকে আয়ত্তে আনার অন্যান্য উপায়– এ সবই হলো রাষ্ট্রের আসল সত্তা। সত্তরের দশকের নকশালবাড়ী আন্দোলনের উপর ভারতের শাসকবাহিনি যেই বর্বরতা চালিয়েছিল সেটাকে কেন্দ্র করেই নবারুণ রাষ্ট্রের চেহারাটাকে চিহিৃত করেছেন। নবারুণ লেখেন, লক-আপের পাথর হিম কক্ষে/…হত্যাকারীর পরিচালিত বিচারালয়ে/ মিথ্যা অশিক্ষার বিদ্যায়তনে/ শোষণ ত্রাসের রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে/ সামরিক অসামরিক কর্তৃপক্ষের বুকে/ কবিতার প্রতিবাদ ধ্বনিত হোক [এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না]।
কবি আসলে আইডিয়া নিয়ে কাজ করে। হয়তো তাকে ইউটোপিয়ানও বলা যাবে। অনেক সময় কবি যেই আইডিয়ার কথা বলে সেটা সম্ভাবনাময়। নবারুণ এখানে রাষ্ট্রের আরো কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কথা বলেন যেমন বিচারলায়, বিদ্যায়তন, থানা ইত্যাদি। রাষ্ট্রের নিপীড়নের প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি বলেন, হাজার ওয়াট আলো চোখে ফেলে রাত্রিদিন ইন্টারোগেশন/মানি না/ নখের মধ্যে সূঁচ বরফের চাঙড়ে শুইয়ে রাখা/ মানি না/ পা বেধে ঝুলিয়ে রেখে যতক্ষণ রক্ত ঝরে নাক দিয়ে/ মানি না/ ঠোঁটের ওপরে বুট জ্বলন্ত শলাকায় সারা গায়ে ক্ষত/ মানি না/ ধারালো চাবুক দিয়ে খন্ড খন্ড রক্তাক্ত পিঠে সহসা অ্যালকোহল/মানি না/ নগ্নদেহে ইলেকট্রিক শক কুৎসিৎ বিকৃত যৌন অত্যাচার/ মানি না/ পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা খুলির সঙ্গে রিভলভার ঠেকিয়ে গুলি/ মানি না/ কবিতা কোনো বাধাকে স্বীকার করে না।
শেষের কথাটা হয়তো সত্য কিন্তু সব কবিতাতো একরকম নয়। একশো উনিশ লাইনের এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না নামের কবিতাটার মধ্যে রাষ্ট্রের স্তম্ভগুলো ও তাদের ব্যবহার সম্পর্কে তিনি বাস্তবভিত্তিক প্রমাণ এঁকেছেন।
নবারুণ ভট্টাচার্য আগাগোড়া বিপ্লবী কবি। তবে তার কবিতায় তিনি দরকারি কথাগুলোকেও কবিতা করে তুলেছেন। যেমন, রোজ রাত্তিরে আমাদের জুয়ায়/ কেউ না কেউ জিতেই নেয় চাঁদ/ চাঁদ ভাঙিয়ে আমরা খুচরো তারা করে নেই [লুম্পেনদের লিরিক]। ভিয়েতনাম থেকে শুরু করে বিশ্বরাজনীতির সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ধারায় প্রতিবাদ প্রতিশোধের লাইন টানা আছে নবারুণের কবিতায়। ফরাসি মার্কসবাদী কবি লুই আরাগঁকে বলা হতো সুররিয়ালিস্টিক কবি। মার্কসবাদের সঙ্গে সুররিয়ালিজমের কোথায় যেন একটা যোগ আছে। নবারুণ যখন বলেন, ল্যাম্পপোস্টের ওপর থেকে/ হতভাগ্যরা গলায় দড়ি দিয়ে ঝোলে/ তাদের ছায়ায় কালোবাজারীরা/ লুকোচুরি খেলে/ ভি, ডি, বেশ্যার দালাল আর/ জেমস বন্ডরা রাস্তায় কিলবিল করে [ খারাপ সময়]।
লুই আরাগঁও প্রথমজীবনে বিপ্লবী মার্কসিস্ট কবি হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। পরে ব্রেতোঁ, এলুয়ার যোগে তাদের হাতেই তো বলতে গেলে সুররিয়ালিজম ও দাদাবাদের জন্ম হয়। তাদের ইশতেহারও ছিল তাই যে সাহিত্য কোনো বাধা মানে না। সেটা একটা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র, কবিতাই যার সংবিধান। লুই আরাগঁ দুইটা বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা সম্মৃদ্ধ কবি। এই যে আরাগঁরা বলতো,সমাজ যাকে সাহিত্য নামে অভিহিত করে, তা তো ছকে ফেলা লেখা, রাষ্ট্রের কাঠামোর ব্যাখ্যা। বানানো সাহিত্য। এই তথাকথিত সাহিত্যকে ও প্রতিষ্ঠিত সমাজ কাঠামোকে একই সঙ্গে অগ্রাহ্য করতে হবে। এমনকি সমাজ অনুমোদিত প্রতিষ্ঠিত ভাষাটাকেও। এওতো আসলে রাষ্ট্রনামক প্রতিষ্ঠানটির মুখোশ খুলে দেয়ার মতোই। নবারুণ যেমন চেতনা আর অবচেতনাকে একাকার করে ফেলেন তেমনি আরাগঁও বলতেন, চেতনা অবচেতনায় যা কিছু থাকে সবই সমান সত্য। স্বপ্ন ও বাস্তব এই দুই অবস্থাকে এক পরম বাস্তবে মূর্ত করতে হবে। সুরলিয়ালিস্টরা লেনিন অনুপ্রাণিত রুশবিপ্লব, ফ্রয়েডের মনসমীক্ষণ তত্ত্ব, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের মতো ইতিবাচক ত্রয়ীর দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। আরাগঁ শেষ পর্যন্তই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
নবারুণের শেষের দিকের একটা উপন্যাসের নাম পৃথিবীর শেষ কমিউনিষ্ট। প্রতিবাদের আর প্রতিরোধের ঝনঝনানি থাকা সত্তেও নবারুণের কিছু কিছু কবিতার লাইন একেবারেই নতুন ইমেজে হাজির হয় আমাদের সামনে। যেমন শ্বাসরুদ্ধ নোনাজল ঠেলে/ জুয়াড়ির নৌকো যায় ফসফরাস আহ্বান জ্বেলে/ দেখেছি আকাশতলে, মৃতদেহ বিক্রয়ের হাটে [ জুয়াড়ির নৌকো]। অথবা বুর্জোয়া লেখকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আগ্নেয়গিরির মুখে/ একটা কেটলি বসানো আছে/ সেখানে আজ আমার/ চা খাওয়ার নেমন্তন/… হে লেখক, প্রবল পরাক্রান্ত কলমচি/ আপনি যাবেন? [ হে লেখক]। অথবা একদিন পেট্রল দিয়ে/ সব আগুন আমি নিভিয়ে দেব/ সব আগুন আমি নিভিয়ে দেব/ পেট্রল দিয়ে। [ পেট্রল আর আগুনের কবিতা]। বা মৃত চিত্রতারকার মাংসের খোঁজে/ কয়েকটি আরশোলা ও একটি ইঁদুর। [ টেলিভিশন]।
২০১১ সালের মে মাসে কলকাতায় বিনায়ক সেনের জেলফেরত উপলক্ষে মহাবোধি সোসাইটির সম্মেলন কক্ষে তীব্র বক্তৃতা রাখছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্য। বয়সের ছাপ পড়েছে বলে মনে হচ্ছিল খানিকটা। তবু কি তীব্রতা তার কথায় স্বভাবে। আমি আগে থেকেই নবারুণের পাঠক ছিলাম। তার তীব্রতাকে সমীহ করতাম কারণ তার একটা পক্ষ ছিল। যেখানে আমির কোনো স্থান নেই। তিনি গণমানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে সিস্টেমের সমালোচক ছিলেন। ডা. বিনায়ক সেনকে সরকারি পুলিশ বাহিনি ধরে নিয়ে গেছে বিনাদোষে আদিবাসীদের সহযোগিতা করার নামে। বিনা বিচারে যেই নির্যাতন করেছে তার প্রতিবাদে তিনি তীব্র বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতা শেষে আমি নিচে অপেক্ষা করছিলাম তার জন্য। পরিচয় পর্ব শেষে কলেজ স্ট্রিটের পাশ দিয়ে হাটতে হাটতে ভাড়ের দোকানে চা খেতে খেতে বলেছিলেন আগুনটা ভাল লাগছে। সব কিছুর মধ্যেই হয়তো তিনি আগুন খুঁজতেন, এমনকি সম্পর্কের মধ্যেও।